মঙ্গলবার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:১৫ অপরাহ্ন

আত্মরক্ষায় কৌশলী মাস্টারমাইন্ড জিয়া

আত্মরক্ষায় কৌশলী মাস্টারমাইন্ড জিয়া

স্বদেশ ডেস্ক:

২০১৩ সালে শুরু। দেশের ব্লগার, লেখক, প্রকাশক ও ভিন্ন মতাদর্শের মানুষের ওপর শুরু হয় নৃশংস হামলা। মুক্তমনা হিসেবে পরিচিত অনেকেই খুন হয়ে যান একের পর এক। এসব খুনের জন্য অভিযোগের তীর ছোটে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের (এবিটি) দিকে। ২০১৫ সালের মে মাসে এ সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ করে সরকার। কিন্তু এতেও তাদের দমানো যায়নি। নিষিদ্ধ ঘোষণার পর এবিটির সদস্যরাই আনসার আল ইসলাম নামে তৎপরতা চালাতে শুরু করে। ২০১৭ সালের মার্চে আনসার আল ইসলামকেও জঙ্গি সংগঠন হিসেবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে সরকার। কিন্তু এর মধ্যেই খুন হয়ে যান অনেক ব্লগার, লেখক, প্রকাশক ও মুক্তমনা মানুষ। একের পর এক ধারাবাহিক এসব হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে বারবার ফিরে এসেছে মেজর জিয়ার নাম। পুরো নাম সৈয়দ জিয়াউল হক জিয়া। সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত এ মেজর অন্তত ৯টি হত্যাকা-ের নাটের গুরু। পুরস্কার ঘোষিত এ শীর্ষ জঙ্গিনেতা ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে এখনো। দেশে একের পর এক চাঞ্চল্যকর হত্যাকা-ের পর রহস্য উন্মোচন করতে গিয়ে বারবার নেপথ্যের প্রধান কুশীলব হিসেবে তার নাম উঠে আসায় নিজেকে রক্ষায় মেজর জিয়াও দিন দিন অধিকতর কৌশলী হয়ে উঠেছেন।

২০১৬ সালের পর আনসারুল্লাহ বাংলা টিম থেকে আনসার আল ইসলামে রূপান্তরিত সংগঠনটিকে টার্গেট কিলিংয়ে দেখা যায়নি। জিয়ার নির্দেশনা মেনে সহিংস উগ্রবাদী পন্থার চেয়ে দাওয়াতি কার্যক্রমের মাধ্যমে সদস্য সংগ্রহের দিকে বেশি মনোযোগী হয়েছে সংগঠনটি। সদস্যদের সংগঠিত করে হামলার পরিকল্পনাও রয়েছে তাদের। জঙ্গিবাদ দমনে নিয়োজিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ সাজার দাবিতে শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন শুরুর ১০ দিনের মাথায় ২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকার মিরপুরের কালশীতে নিজের বাসার কাছে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয় ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দারকে। ২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় খুন হন ব্লগার ও লেখক অভিজিৎ রায়। ২০১৫ সালের ৩০ মার্চ রাজধানীর তেজগাঁও এলাকায় জঙ্গিদের হাতে খুন হন আরেক ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান। একই বছরের ১২ মে সিলেটে নিজ বাসার সামনে জঙ্গিদের হাতে খুন হন আরেক ব্লগার অনন্ত দাস। এর পরের খুনটি হয় ৮৬ দিনের মাথায়। রাজধানীর খিলগাঁও এলাকার ভাড়া বাসায় জঙ্গিদের হাতে খুন হন আরেক ব্লগার নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায়। সে বছরেরই ৩১ অক্টোবর শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটে জাগৃতি প্রকাশনীর কার্যালয়ে জঙ্গিদের হাতে খুন হন প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন। একই দিন একই জঙ্গি সংগঠনের সদস্যরা শুদ্ধস্বর প্রকাশনীর প্রকাশক আহমেদুর রশীদ চৌধুরী টুটুলকে কুপিয়ে জখম করে। ২০১৬ সালের ৬ এপ্রিল সূত্রাপুরে রাস্তায় জঙ্গিদের হাতে খুন হন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও ব্লগার নাজিম উদ্দিন। এসব হত্যাকা-ে এবিটি সদস্যদের সম্পৃক্ততার তথ্য উঠে আসে।

গতকাল ব্লগার ও লেখক অভিজিৎ রায় হত্যা মামলায় জিয়াসহ এবিটির পাঁচ জঙ্গিকে মৃত্যুদ- দিয়েছেন আদালত। এর আগে গত ১০ ফেব্রুয়ারি প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন হত্যা মামলায়ও এই জিয়াসহ এবিটির আট সদস্যের মৃত্যুদ-ের আদেশ দেন আদালত। এ দুই মামলার রায়ের পর ফের আলোচনায় উঠে এসেছে জিয়ার নাম।

২০১৬ সালের ২৫ এপ্রিল কলাবাগানের একটি বাসায় জঙ্গিদের হাতে খুন হন জুলহাজ মান্নান ও তার বন্ধু মাহবুব তনয়। ইউএসএআইডির কর্মকর্তা জুলহাজ সমকামীদের অধিকারবিষয়ক সাময়িকী রূপবান সম্পাদনা ও প্রকাশনায় যুক্ত ছিলেন। আর মাহবুব তনয় নাট্যকর্মী। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, জুলহাজ মান্নান ও মাহবুব তনয় হত্যার পর থেকে এবিটির আর কোনো টার্গেট কিলিংয়ের খবর পাওয়া যায়নি। একের পর এক হত্যাকা-ে মোস্ট ওয়ান্টেড হয়ে ওঠা চাকরিচ্যুত মেজর জিয়া নিজেকে বাঁচাতে ভিন্ন পথ ধরেন। কারণ এসব হত্যাকা-ে জড়িত এবিটির অনেক সদস্য গ্রেপ্তার হতে থাকে। তাদের মুখে মেজর জিয়ার নাম উঠে আসে। মেজর জিয়ার নির্দেশনা অনুযায়ী টার্গেট কিলিংয়ের পথ ছেড়ে আপাতত দাওয়াতি কার্যক্রমের মাধ্যমে সদস্য সংগ্রহের দিকে মনোযোগ দেয় এবিটি। দল আরও সুসংগঠিত করে ফের হামলার পরিকল্পনা রয়েছে তাদের এমনটিই ধারণা করছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। দাওয়াতি কাজে এবিটির নতুন আধ্যাত্মিক নেতা শায়খ তামিম আল আদনানীকে ব্যবহার করা হচ্ছে।

জুলহাজ-তনয় হত্যা মামলার আসামি জঙ্গি আসাদুল্লাহকে সিটিটিসি কর্তৃক গ্রেপ্তারের পর সে তখন পুলিশকে জানায়, এ হত্যাকা-েরও নির্দেশদাতা ছিলেন সাবেক মেজর জিয়া।

২০১৮ সালের ১৭ জুলাই চট্টগ্রাম থেকে এবিটির গোয়েন্দা শাখার প্রধান জুবায়েরকে গ্রেপ্তারের পর মেজর জিয়া সম্পর্কে নতুন কিছু তথ্য পান গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। সে সময় জুবায়ের জানান, তার সঙ্গে মেজর জিয়ার যোগাযোগ হয়েছিল। চট্টগ্রামের নাসিরাবাদের জাকির হোসেন রোডের ৭৬ নম্বর বাড়িতে অবস্থান ছিল জিয়ার। তখন তার মুখে ছিল দাড়ি।

তামিম-সারোয়ারের মতো শীর্ষ জঙ্গিদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনছে সিটিটিসি, এটিইউ ও র‌্যাব। তবে সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে এখনো অধরা আনসারুল্লাহ বাংলা টিম ওরফে আনসার আল ইসলামের প্রধান চাকরিচ্যুত মেজর জিয়া। দুই দফা বিশেষ কমান্ডো প্রশিক্ষণে প্রথম স্থান অধিকার করা মেজর জিয়া অন্য জঙ্গিদের চেয়ে অনেকটাই কৌশলী। আর সে কারণেই গ্রেপ্তার এড়াতে সক্ষম হচ্ছেন বলে মনে করেন কর্মকর্তারা।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, কয়েকটি ঘটনায় জড়িত জঙ্গিদের সেলফোন, কল রেকর্ড পর্যালোচনা, ই-মেইল অ্যাকাউন্ট, ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ঘেঁটে হামলার পরিকল্পনার পেছনে মাস্টারমাইন্ড হিসেবে জিয়ার নামই পাওয়া গেছে।

সেনাবাহিনীতে ব্যর্থ অভ্যুত্থান চেষ্টার পর ২০১২ থেকেই পলাতক জীবনযাপন করছেন মেজর জিয়া। প্রথম স্ত্রী রোগে ভুগে মারা যাওয়ার পর দ্বিতীয় বিয়ে করেন পটুয়াখালী শহরের সবুজবাগ এলাকায়। মেজর জিয়াকে ধরতে তার শ্বশুর মোখলেছুর রহমানের পটুয়াখালীর বাসায় দফায় দফায় অভিযান চালায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তার বাবার নাম জিল্লুল হক। বাড়ি মৌলভীবাজারের মস্তফাপুরে। তার পাসপোর্ট নম্বর এক্স-০৬১৪৯২৩।

এ জঙ্গি নেতা সম্পর্কে জানতে চাইলে সিটিটিসির উপকমিশনার (ডিসি) সাইফুল ইসলাম আমাদের সময়কে বলেন, মেজর জিয়ার বর্তমান অবস্থান নিশ্চিত করতে আমাদের গোয়েন্দা কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। তাকে আইনের আওতায় আনার চেষ্টা চলছে।

মুক্তমনা লেখক, ব্লগারসহ অন্তত ৯টি হত্যার মাস্টারমাইন্ড এই পলাতক জিয়া। ২০১৬ সালের ৪ অক্টোবর তৎকালীন পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) একেএম শহীদুল হক এই জঙ্গিকে ধরিয়ে দিতে ২০ লাখ টাকা পুরস্কারও ঘোষণা করেন।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877